2. আপনার ধর্ম বা বিশ্বাস ধারণ বা পরিবর্তনের অধিকার
স্ক্রিপ্ট: ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা: ধর্ম বা বিশ্বাস পোষণ বা পরিবর্তনের অধিকার
ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার প্রথম মৌলিক দিক হচ্ছে স্বাধীনভাবে ধর্ম বা বিশ্বাস পোষণ, ধারণ, পরিবর্তন বা ত্যাগের স্বাধীনতা। এটি একান্তই আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের বিষয় এবং এটি ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতার অর্ন্তনিহিত বিষয় হিসেবেই পরিচিত। ধর্ম বা বিশ্বাস পালন বা পরিবর্তনের অধিকার একেবারেই আপনার নিরঙ্কুশ অধিকার, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে এই অধিকারের উপর কখনোই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যায় না। আপনি খ্রিষ্টান, মুসলিম, বাহাই, ইয়েজিদী বা নিরীশ্বরবাদী যেই হোন না কেন, অথবা আপনি সিঙ্গাপুর, সুইডেন বা সুদান যেখানেই থাকুন না কেন, সেখানে শান্তি থাকুক কি যুদ্ধ, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যাই বলুক না কেন – আপনিসহ প্রত্যেকটি মানুষের নিজস্ব বিশ্বাস ধারণ ও পালন করার, বা পরিবর্তন করার, কিংবা নিরীশ্বরবাদী হওয়ার অধিকার রয়েছে।
অবশ্য অনেক মানুষই এই নিরঙ্কুশ অধিকার থেকে বঞ্চিত হন এবং তাদের ধর্ম বা বিশ্বাসের জন্য সরকার, পরিবারের সদস্য বা সমাজের মানুষের দ্বারা হামলার শিকার হন বা শাস্তি ভোগ করেন।
কোনো কোনো সরকার কোনো বিশেষ ধর্ম বা বিশ্বাসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে থাকে। ফালুন গঙ হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসর একটি বিশেষ ধরন এবং অনুশীলন যা চীনে নিষিদ্ধ। ফালুন গঙ অনুসারীদের কারাবাস, নির্যাতন, জোরপূর্বক শ্রম এবং তাদের নিজ বিশ্বাস ত্যাগ করার লক্ষ্যে জোরপূর্বক শিক্ষা গ্রহণের মত নিগ্রহ সহ্য করতে হয়েছে।
ইরিত্রিয়ায় মাত্র চারটি ধর্ম রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি নেই এমন ধর্মের অনুসারীদের, যেমন- পেন্টিকস্টাল খ্রিষ্টান এবং যিহোভা’স উইটনেসদের বিভিন্ন উপায়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছে।
কোনো ধর্ম বা বিশ্বাস পালনের অধিকার লঙ্ঘনের আরও সুস্পষ্ট একটি উদাহরণ হচ্ছে ঘৃণাজাত অপরাধ, যেখানে ধর্মীয় পরিচয় বা বিশ্বাসের কারণে একজন ব্যক্তি নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। শুধুমাত্র একটি বিশেষ ধর্ম বা বিশ্বাস ধারণ করেন বলেই তারা আক্রান্ত হন।
২০১৫ সালে ফ্রান্সে মুসলিমদের প্রতি আক্রমণ, হয়রানি বা অপরাধজনিত ক্ষয়ক্ষতির মত ঘৃণাজাত অপরাধের পরিমাণ শতকরা ২৫০ ভাগ বেড়ে যায় এবং সে বছর এ ধরনের ৩৩৬টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়। এদিকে ইহুদী সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণাজাত অপরাধের উচ্চমাত্রা বজায় ছিল, এ সংক্রান্ত নথিভুক্ত ঘটনার সংখ্যা ছিল ৭১৫টি।
মেক্সিকোর প্রত্যন্ত কিছু কিছু অঞ্চলে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টানরা তাদের এলাকার স্থানীয় নেতাদের দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন বা নিজের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন, কারণ সেই নেতারা শুধুমাত্র ঐতিহ্যবাহী ও ক্যাথলিক ধর্মকেই সংরক্ষণ করতে চায়।
অনেক দেশেই ধর্মীয় পরিচয়, জাতিগত পরিচয় এবং রাষ্ট্রীয় পরিচয় একটি অন্যটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সেসব ক্ষেত্রে যারা বড় কোনো ধর্ম বিশ্বাস ত্যাগ করে সংখ্যালঘু ধর্মবিশ্বাস গ্রহণ করে অথবা যারা নিরীশ্বরবাদী, তাদেরকে অনেক সময় রাষ্ট্রদোহী অথবা জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কোনো ধর্ম বা বিশ্বাস ত্যাগ করার নিরঙ্কুশ অধিকারকে প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়।
ইন্দোনেশিয়ায় ধর্মীয় স্বাধীনতার আইন রয়েছে, যদিও তা নির্দিষ্ট কিছু ধর্ম যেমন- ইসলাম, ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ধর্ম, কনফুশিয়ানিজম এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। নিরীশ্বরবাদ এই আইনের আওতায় সুরক্ষিত নয়। ফেইসবুকে নিরীশ্বরবাদ সম্পর্কিত পেইজ খোলা এবং “ঈশ্বরের কোনো অস্তিত্ব নেই” লেখার অভিযোগে মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া ৩০ বছর বয়সী এ্যালেক্স এ্যান আড়াই বছরের কারাবাস এবং ১১,০০০ মার্কিন ডলার জরিমানা প্রদানের মত শাস্তি পেয়েছেন।
এ্যানের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টির লক্ষ্যে গুজব রটানো, ইন্টারনেটে ধর্মদ্রোহিতামূলক বার্তা ছড়ানো এবং অন্যদেরকে নিরীশ্বরবাদী হওয়ার আহ্বান জানানোর অভিযোগ ছিল। এ্যান তার ফেসবুক পেইজে প্রকাশ্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করার পরও তাকে উন্মত্ত জনতার হাতে মার খেতে হয়েছে এবং তাকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে।
ইরানে কোনো ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করলে তাকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়, বিশেষ করে যদি তিনি কোনো অনিবন্ধিত ঘরোয়া গীর্জার সাথে জড়িত থাকেন। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে এমন চার জন ধর্মান্তরিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে “জাতীয় নিরাপত্তা লঙ্ঘন” করার অভিযোগ এনে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এর আগে তাদের মধ্যে তিনজনকে খ্রীষ্ট ধর্মীয় রীতি অনুসারে ওয়াইন পান করার অপরাধে ৮০ ঘা চাবুক মারা হয়েছিল, কারণ সরকার তাদেরকে তখনো মুসলিম হিসেবেই গণ্য করছিলো এবং ইরানে মুসলিমদের জন্য মদ্যপান শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সংখ্যাগুরু ধর্ম ত্যাগ করা বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বা শাস্তির সমর্থনে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতারা অনেক সময় ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি বা ধর্মীয় প্রথাগত আইনকে নিজেদের সুবিধামত ব্যাখ্যা করে থাকেন। এসব শাস্তির মধ্যে থাকতে পারে মৃত্যুদণ্ড, কারাদণ্ড, চাকরি থেকে বরখাস্ত অথবা দাম্পত্য সম্পর্কের বিচ্ছেদ এবং সন্তান লালন-পালনের অধিকার হারানো। সৌদি আরব এবং পাকিস্তানসহ বেশ কিছু মুসলিমপ্রধান দেশে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করার ক্ষেত্রে এ ধরনের আইনানুগ বিধিনিষেধ রয়েছে। তবে সব ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা এমন নয়। যেমন, সিয়েরা লিওনে মোট জনসংখ্যার ৭০ ভাগ মুসলিম ও ২০ ভাগ খ্রিষ্টান। সেখানে ধর্ম সর্বজনীন, তাতে রাজনীতির কোনো প্রভাব নেই এবং এক ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা।
তবে এ ধরনের সমস্যা কেবল মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে সীমাবদ্ধ নয়। মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের কিছু কিছু অঞ্চলে তথাকথিত এ্যান্টি-বলাকা সামরিকজান্তা সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রাণহানির ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করছে। ভারতের একাধিক রাজ্যে আইন করে ধর্ম পরিবর্তনের অধিকার নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি তার ধর্ম পরিবর্তন করতে চাইলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণের বিধান করা হয়েছে।
এই অধিকার শুধুমাত্র সরকারই ক্ষুণ্ন করছে তা নয়। ভারতে সহিংস ধর্মীয় দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে যেখানে হিন্দু জাতীয়তাবাদী কয়েকটি দল সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের উপরে আক্রমণ চালিয়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করেছে। অনেক সময় সহিংসতার ফলে বসতবাটী থেকে বিতারিত মানুষদেরকে ধর্মান্তরিত হতে রাজি হলে তবেই তাদের ফিরে আসতে দেওয়া হয়।
শুধু যে ধর্মের অনুসারি ব্যক্তিরাই এ ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তা নয়। যারা ধর্মীয় মতবাদ বা ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে সমালোচনা করেন তারাও বিভিন্ন বিপদের সম্মুখীন হতে পারেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্মীয় মতবাদ, চর্চা এবং রাষ্ট্রকে নিয়ে সমালোচনা করার জন্য বাংলাদেশের একাধিক ব্লগার মৌলবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন। দুঃখজনকভাবে, সহিংস মৌলবাদী দলগুলোকে নিষ্ক্রিয় করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টা এখনো সফলতা অর্জন করতে পারেনি। কোনো কোনো সরকার ধর্মীয় ভাবনার সমালোচনাকারীদের উপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়। এই নীরবতা ‘সহিংসতা সমর্থনযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য’ এমন বার্তাই দেয়।
ধর্ম বা বিশ্বাস পরিবর্তনের স্বাধীনতা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খুবই বিতর্কিত একটি বিষয়। বস্তুত, জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো যখনই একটি নতুন চুক্তি বা ঘোষণায় সম্মত হয়েছে, সেখানে ধর্ম পরিবর্তনের অধিকারের বিষয়টি দুর্বলভাবে অর্ন্তভুক্ত হয়েছে।
কিন্তু জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিটি যাদের কাজ হচ্ছে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক চুক্তির ব্যাখ্যা সম্পর্কে রাষ্ট্রগুলোকে পরামর্শ দেওয়া, তাদের মতে, “কোনো ধর্ম বা বিশ্বাস ‘ধারণ করা বা গ্রহণ করার’ স্বাধীনতা অনিবার্যভাবে কোনো ধর্ম বা বিশ্বাস বেছে নেওয়ার স্বাধীনতার পাশাপাশি একজন ব্যক্তির বর্তমান ধর্ম বা বিশ্বাস ছেড়ে ভিন্ন কোনো ধর্ম বা বিশ্বাস অথবা নিরীশ্বরবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের স্বাধীনতা এবং সেই সাথে বর্তমান ধর্ম বা বিশ্বাসে স্থির থাকার স্বাধীনতাকেও বোঝায়।”
সংক্ষেপে বলতে গেলে –ধর্ম বা বিশ্বাস ধারণ অথবা পরিবর্তনের নিরঙ্কুশ অধিকার আপনার রয়েছে। কোনো অবস্থাতেই তা নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। তথাপি, কোনো কোনো রাষ্ট্রের সরকার এই অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এবং এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে কোনো বিশেষ ধর্ম বা বিশ্বাস ধারণ বা গ্রহণের জন্য পরিবার বা সমাজ কর্তৃকও বিভিন্ন শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়।
এই ওয়েবসাইটের প্রশিক্ষণ উপকরণসমূহ থেকে ধর্ম বা বিশ্বাস ধারণ বা পরিবর্তনের অধিকার এবং এ সম্পর্কিত মানবাধিকার দলিলসমূহ সম্পর্কে আরও জানতে পারবেন ।
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত: এসএমসি ২০১৮
End of Transcript